• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সারা দেশ

হত্যার স্বীকারোক্তি নিয়ে খন্ডিত লাশ উদ্ধারের মামলার আসামীরা অজ্ঞাতনামা

  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:

কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় এক যুবকের ৯ টুকরো লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।  গতকাল শনিবার সকালে উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর বোয়ালদহসংলগ্ন পদ্মার চরের চারটি স্থানে পুঁতে রাখা লাশের টুকরোগুলো উদ্ধার করা হয়।  লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ গণমাধ্যমকর্মীদের জানায়, চাঁদার দাবিতে সজীব নামে এক যুবকের নেতৃত্ব এই হত্যাকান্ড হয়েছে। এ ঘটনায় ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ।  জানা গেছে,হত্যার নেতৃত্বদানকারী সজীব  শেখ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি।  সে শহরের হরিবাসর এলাকার মৃত মিলন শেখের ছেলে।

নিহত যুবকের নাম মিলন হোসেন (২৭)।  তিনি জেলার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের বাহিরমাদি পূর্ব পাড়ার মওলা বক্সের ছেলে।  তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং ই-ব্লকের ভাড়া বাসায় থাকতেন।  কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে টেক্সটাইল প্রকৌশলে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন।  সজীব ছাড়াও আটক ছয়জনের মধ্যে আছেন শহরের হাউিজং ই-ব্লকের সজল, আড়য়াপাড়া এলাকার লিংকন,সদর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর গ্রামের জহির রায়হান,সদরের কুমারগাড়া এলাকার ফয়সাল আহমেদ ও হাউজিং এলাকার ইফতি খান।  এ ঘটনায় শনিবার রাতে নিহতের মা শেফালী খাতুন বাদী হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। তবে মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে।

কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) শেখ মোহাম্মদ সোহেল রানা আজকের পত্রিকাকে মামলা দায়েরর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।  তিনি জানিয়েছেন,আটককৃতরা তদন্তপ্রাপ্ত আসামী।  দুপুরে তাদেরকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।  আটককৃতরা হত্যার স্বীকারোক্তি দেওয়ার পরও মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামী করার ব্যাপারে তিনি বলেন,নিহতের পরিবার আসামী কাউকে চিনতো না।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কুষ্টিয়া মডেল থানার উপপরিদর্শক(এসআই) সাজু মহন সাহা জানান, কুষ্টিয়া সদর আমলী আদালতের বিচারক মাহমুদা সুলতানা আটককৃতদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী শেষে তাদেরকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।  এর আগে শনিবার লাশ উদ্ধারের পর অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) পলাশ কান্তি নাথ সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিলেন,গত ৩১ জানুয়ারি সকালে মিলন বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন।

ওই দিন সন্ধ্যায় তাঁর স্ত্রী মিমি খাতুন কুষ্টিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।  জিডির পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ।  পলাশ কান্তি বলেন, ‘বাসা থেকে সজল নামে যে বন্ধু মিলনকে ডেকে নিয়ে যায় প্রথমে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।  তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারি চাঁদার দাবিতে সজীবসহ আরো কয়েকজন মিলে মিলনকে নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুম করেছে।  এরপর শুক্রবার বিকেলে অভিযান চালিয়ে সজীবসহ আরও চারজনকে আটক করা হয়।  টানা জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা মিলনকে হত্যা করে লাশ টুকরো করে নদীর চরে পুঁতে রাখার বিষয়টি স্বীকার করেন।’

শুক্রবার রাত ২টার পর আটক ব্যক্তিদের নিয়ে হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর বোয়ালদহ পদ্মা নদীর চরে পুলিশ অভিযানে যায় বলে জানান এই কর্মকর্তা।  তিনি বলেন, ‘রাতভর অভিযান চালিয়ে নদীর চরের চারটি স্থান থেকে মিলনের ৯টি থেকে ১০টি খন্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়।  এ ছাড়া হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র কুমারখালীর বাধবাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।  এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ৭টি ব্যাগে করে লাশগুলো নদীর চরে আনা হয়েছিল।‘  জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, টাকার দাবিতে মিলনকে হত্যা করা হয়েছে।

মিলন অনলাইনে আউটসোসিং করে ভালো  টাকা পয়সা আয় করতেন।  বিষয়টি সজীবের নজরে পড়লে দলবলসহ মিলনের কাছে চাঁদা দাবি করে।  চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ডেকে নিয়ে মারধর করা হয়।  মারধরের এক পর্যায়ে মিলন মারা যায়।  ওই দিন রাতেই লাশ গুম করার সুবিধার্থে ধারালো অস্ত্র দিয়ে টুকরো করে নদীর চরে পুঁতে রাখা হয়েছিল।  আর এই পুরো হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন সজীব।  এর সঙ্গে অন্য কোনো ঘটনা আছে কি না, তা নিয়ে আরও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’  

আজ রবিবার(০৪ ফেব্রয়ারি) বেলা ১টার দিকে নিহত মিলনের গ্রামের বাড়ি দৌলতপুর উপজেলার পূর্ব বাহিরমাদি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়,বাড়িতে প্রতিবেশীদের ভিড়।  নিহত মিলনের মা শেফালী খাতুন ও স্ত্রী মিমি খাতুন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছে।  বাড়িতে উপস্থিত থাকা স্বজনরা তাদেরকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছেন।  একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে উঠোনের এক কোনে নির্বাক দৃষ্টিতে বসে আছেন অসুস্থ বাবা মওলা বক্স।  গতকাল শনিবার বিকেলে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে মিলনের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌছালে সেখানে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।  বাদ মাগরিব স্থানীয় গোরস্থানে মিলনের দাফন সম্পন্ন হয়।

এদিকে প্রতিবেদক মামলার বিষয়ে নিহত মিলনের মা ও স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চাইলে বড় বোন সেলিনা খাতুন বারবার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।  এক পর্যায়ে কথা হয় স্ত্রী মিমি খাতুনের সাথে। তিনি জানান,থানায় সাধারণ ডায়েরি(জিডি) করার পর পুলিশ শুধু আমার বয়ান নিয়েছিল।  তদন্ত করে তারাই(পুলিশ) বের করেছে,বর্ণনাও তারা দিয়েছে।  আমার শাশুড়ি শুধু বাদীর জায়গায় স্বাক্ষর করেছে।  আটকের পরেও মামলায় আসামী অজ্ঞাতনামা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,পুলিশ তদন্তপূর্বক আস্তে আস্তে আগে বাড়বে বলছে.এখনো তদন্ত বাকি আছে।

এজন্য হয়তো কিছু লুকিয়ে রাখছে।  তিনি বলেন,থানায় জিডি করার পর আটক সজলের বড় ভাই আমাকে হুমকি দিয়েছিল।  চাঁদা দাবির বিষয়ে তিনি বলেন,চাঁদা চাইলে সে(মিলন) আমাকে জানাতো।  আটককৃতদের মধ্যে সজল ছাড়া আমি কাউকে চিনি না।  একই এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে তারা কয়েকজন অনলাইনে আউটসোসিং-এর কাজ করতো।  এ সময় তিনি এমন নৃশংস হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আটককৃতদের যাতে জামিন না দেওয়া হয় সেই দাবি জানিয়ে তাদের ফাঁসি চান।

মামলার বাদী শেফালী খাতুন বলেন, মামলার বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারি না।  শুধু স্বাক্ষর করেছি।  তার একটাই দাবি ছেলে হত্যার বিচার চায়।  পরিবার ও প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে,৮ মাস আগে পাশবর্তী প্রাগপুর ইউনিয়নের মহিষকুন্ডি জামালপুর গ্রামের মহিবুল ইসলামের মেয়ে মিমি খাতুনের সাথে মিলনের বিয়ে হয়।  স্ত্রী মিমি খাতুন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সন্মান শেষ বর্ষের ছাত্রী।  দুই জনের পড়াশুনার সুবিধার্থে বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে সে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং ই-ব্লকের একটি তিনতলা বাড়ির নিচ তলায় ভাড়া থাকতেন।

স্থানীয় ইউপি মেম্বর হান্নান সরদার জানান,মিলন খুব ভালো ছেলে ছিল।  গ্রামের সবাই তাকে ভালো বাসতো।  মিমির সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার।  পরে পারিবারিভাবে বিয়ে দেওয়া হয়।  ভালোই চলছিল তাদের সংসার। দুইজনেই কুষ্টিয়া শহরে থেকে পড়াশুনা করতো।  তবে এর পাশাপাশি কি করতো তা জানা ছিল না।  গ্রামের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়,চার বোনের ছোট মিলন।  কৃষক বাবার সন্তান মিলন এসএসসি পরীক্ষা পাশ করার পর কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-এ ভর্তি হয়।  পড়াশুনার সুবিধার্থে তখন থেকেই সে কুষ্টিয়া শহরে বসবাস করতেন।  শহরের ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি গ্রামে মা-বাবাকেও আর্থিক সহযোগিতা করতেন তিনি।  তবে প্রতিবেশী কয়েকজন পড়াশুনার পাশাপাশি মিলন শহরে কি কাজ করতেন তা বলতে পারেনি।  

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, হাউজিং ই-ব্লকের চাঁদাগাড়া মাঠ সংলগ্ন একটি বহুতল ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় রুম ভাড়া নিয়ে মিলন সেখানেই অনলাইনে আউটসোসিং-এর কাজ চালাতো।  সকাল সাড়ে ১১টায় ঐ অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয় সে।  তবে ঐ ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলেদের যাওয়া আসা দেখলেও তারা সেখানে কি করতো তা আশে-পাশের কেউ বলতে পারেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানায়,পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে জানতে পারলাম মিলনকে ভাড়া নেওয়া বাসাতেই নির্যাতন করা হয়েছিল।  তবে আটকৃকতরা সবাই একে অপরের পরিচিত ছিল।  ঐ অফিসে আগে থেকে সজীবের যাওয়া আসা ছিল।  সজীবের নেতৃত্বে হাউজিং এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। ঐ এলাকায় অপকর্ম করাই তাদের কাজ।  মিলনের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিল সজল।  সেই তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসে।  স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই এই হত্যাকান্ড ঘটতে পারে।

 এ বিষয়ে জানতে বাড়ির মালিক ও অন্য ভাড়াটিয়াদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা কিছু বলতে রাজি হয়নি।  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,হত্যাকান্ডের মূল হোতা সজীব জেলা ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সাবেক সহসভাপতি।  পাশাপাশি পুলিশের তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং-প্রধান।  সজীবের নেতৃত্বে কুষ্টিয়া শহরে একটি গ্যাং চলে।  বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করছেন তিনি। তবে কোনো পদ-পদবি নেই।  কলেজে পড়ালেখা না করেও হঠাৎ করে ছাত্রলীগের পদ পেয়ে যান তিনি।  ইয়াসির আরাফাত ও সাদ আহাম্মেদের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে ২০১৭-১৮ সালের দিকে প্রথম সহসম্পাদকের পদ পান।

তখন থেকেই শহরের হাউজিং এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি করে এলাকায় চাঁদাবাজি, মারপিট, মাদকের কারবারসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন।  এরপরও নেতাদের সুপারিশে জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়ে যান তিনি।  এরপর সজীব আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।  শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায়।  জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজ চ্যালেঞ্জের ওপর হামলাসহ নানা অপকর্মের কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।  সজীবের নামে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মাদক, চাঁদাবাজি, হামলাসহ নানা অভিযোগে পুরোনো সাতটি মামলা আছে।  কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরের মামলায় তাঁর দুই বছরের সাজাও হয়েছিল।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads